ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার উত্তর অংশে নিজ বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ফিলিস্তিনি ফটোসাংবাদিক ফাতিমা হাসোনা।
ভয়ানক এই হামলায় একইঙ্গে তার পরিবারের আরও ১০ সদস্যও নিহত হন। তবে ফাতিমার জীবনের পথ থেমে গেলেও, থেমে যায়নি তার গল্পের পথচলা। বিশ্ববিখ্যাত কান চলচ্চিত্র উৎসবে আগামী মাসে প্রদর্শিত হবে তাকে নিয়ে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র।
বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) মার্কিন বিনোদনমাধ্যম ভ্যারাইটির প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কানে নির্বাচিত একটি তথ্যচিত্রের মূল চরিত্র ছিলেন ২৫ বছর বয়সী এই ফিলিস্তিনি আলোকচিত্রী। তিনি ছিলেন গাজার ইউনিভার্সিটি কলেজ অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্সেসের স্নাতক। শুধু একজন সাংবাদিক বা আলোকচিত্রী হিসেবে নয়, ফাতিমা ছিলেন সেই কঠিন বাস্তবতার জীবন্ত সাক্ষী, যা দিনের পর দিন আরও নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে গাজার মানুষের জন্য।
নিহত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেও তিনি ফেসবুকে নিজের বারান্দা থেকে গৃহীত একটি সূর্যাস্তের ছবি শেয়ার করে লিখেছিলেন, অনেক দিনের মধ্যে এটি প্রথম সূর্যাস্ত। এর আগে আরেকটি পোস্টে লিখেছিলেন, ‘অনিবার্য মৃত্যুর কথা বলতে গেলে, যদি আমি মারা যাই, আমি একটি উচ্চস্বরে মৃত্যু চাই, আমি চাই না যে আমি কোনো ব্রেকিং নিউজ স্টোরিতে থাকি অথবা কোনো দলের সঙ্গে কোনো সংখ্যায় থাকি। আমি এমন একটি মৃত্যু চাই যা বিশ্ব শুনতে পায়। এমন একটি চিহ্ন যা চিরকাল স্থায়ী হয়- অমর চিত্র যা সময় বা স্থান কেউই কবর দিতে পারবে না।’
তার এই আকাঙ্ক্ষা যেন সত্যিই হয়ে উঠল। ‘Put Your Soul on Your Hand and Stroll’ শিরোনামের তথ্যচিত্রে প্রধান চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছে ফাতিমার জীবন ও সংগ্রামের গল্প। ১১০ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই ডকুমেন্টারিটি নির্মাণ করেছেন পরিচালক ফরহাদ ফারসি।
পরিচালক জানান, এটি মূলত গত এক বছরের মতো সময়জুড়ে ফাতিমা ও তার মধ্যে চলা কথোপকথনের ভিত্তিতে নির্মিত। এটি শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, বরং গাজায় চলমান গণহত্যার একটি জীবন্ত দলিল।
প্রসঙ্গত, এসিড (অ্যাসোসিয়েশন ফল দ্য ডিস্ট্রিবিউশন অব ইন্ডিপেনডেন্ট সিনেমা) বিভাগের অধীনে তথ্যচিত্রটি কানে প্রদর্শিত হবে।
এসিডের ওয়েবসাইটে দেওয়া বিবরণে পরিচালক ফারসি লেখেন, এই ফিল্ম একটি জানালা, যা খুলেছে ফাতমার সঙ্গে এক অলৌকিক সাক্ষাতে। সে গাজার ভেতরে আমার চোখ, আর আমি বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগাযোগ। আমি ভাবছি, এই সিনেমায় কাজ করাই কি তাকে টার্গেট হওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে গেল না?
ফাতিমা যখন কানে অংশ নেওয়ার খবর পান, তখন ফারসি চেষ্টা করছিলেন তাকে কানে নিয়ে যাওয়ার পন্থা খুঁজতে। ফাতিমা তখন ভাবছিলেন, কীভাবে কানে গিয়ে আবার গাজায় ফিরে আসবেন। কিন্তু ভাগ্য তার পক্ষে ছিল না। গল্প পৌঁছাল বিশ্বমঞ্চে, কিন্তু ফাতিমা থাকলেন না সেই মুহূর্তের সাক্ষী হতে।
ফাতিমার প্রাণ বিসর্জনের ঘটনায় সাংবাদিক মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর কমিশনার জেনারেল ফিলিপে লাজারিনি বলেন, ফিলিস্তিনি সাংবাদিকরা বীরত্বের সঙ্গে কাজ করে চলেছে, কিন্তু এর জন্য তাদের ভয়ংকর মূল্য দিতে হচ্ছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত গাজায় ২০৯ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, যাদের কেউ ডিউটিতে ছিলেন, কেউ বাড়িতে।
ফাতিমা হাসোনা- একজন চিত্রসাংবাদিক, একজন কণ্ঠস্বর, একজন সাহসী হৃদয়। তার চোখ দিয়ে বিশ্ব দেখেছে গাজার বাস্তবতা। আজ তিনি নেই, কিন্তু তার গল্প বেঁচে আছে এবং সেটিই পৌঁছে গেছে কানের মতো বিশ্বমঞ্চে।
ফাতিমার সেই উচ্চস্বরে মৃত্যুই হয়তো আজ বিশ্বের কানে ধ্বনিত হচ্ছে।