বাংলাদেশে রান্না, ঘরদোর পরিষ্কার, কাপড় ধোয়া, পরিবার পরিচালনা কিংবা শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠদের যত্ন নেওয়ার মতো অবৈতনিক কাজের অর্থনৈতিক মূল্য প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে হিসাব করা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউএন উইমেন বাংলাদেশের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে এসব কাজের আর্থিক মূল্য দাঁড়িয়েছে ৬.৭ ট্রিলিয়ন টাকা, যা জাতীয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৮.৯ শতাংশের সমান।
মঙ্গলবার (০৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) অডিটরিয়ামে প্রকাশিত হাউসহোল্ড প্রোডাকশন স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্টে (এইচপিএসএ) এ তথ্য জানানো হয়। প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ।
বিশেষ অতিথি ছিলেন নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার। এ ছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন ইউএন উইমেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি গীতাঞ্জলি সিংহ। অনুষ্ঠান সভাপতিত্ব করেন বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
প্রতিবেদন অনুযায়, এই বিশাল অঙ্কের মধ্যে নারীর একক অবদান প্রায় ৮৫ শতাংশ। অর্থাৎ, দেশের অর্থনীতির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ সমান অবৈতনিক কাজের প্রধান চালিকাশক্তি নারী। অন্যদিকে পুরুষদের অবদান মাত্র ১৫ শতাংশ। সংখ্যাটি স্পষ্ট করে দেয়, গৃহস্থালি ও যত্নশীল কাজের দায়িত্বে লিঙ্গবৈষম্য কতটা গভীর।
প্রচলিত অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে অবৈতনিক কাজের হিসাব ধরা হয় না। ফলে নারী শ্রমের একটি বড় অংশ এতদিন ‘অদৃশ্য’ থেকে গেছে। অথচ ৬.৭ ট্রিলিয়ন টাকার এই অবদান বাস্তবে জিডিপিতে দৃশ্যমান হলে, নারীর কাজের সামাজিক স্বীকৃতি এবং অর্থনৈতিক মর্যাদা আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিবিএসের উপপরিচালক আসমা আখতার। তিনি জানান, সময় ব্যবহার জরিপ ২০২১ এবং শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর তথ্য বিশ্লেষণ করে এই হিসাব তৈরি হয়েছে। অনুষ্ঠানে ইউএন উইমেনের নুবাইরা জেহেন ‘কেয়ার ক্যালকুলেটর’ নামের সরঞ্জাম ব্যবহার করে দেখান, একজন মানুষ প্রতিদিন কতটা সময় অদৈত কাজে ব্যয় করেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই অদৈত কাজকে অর্থনীতির মূলধারায় আনতে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- যত্ন খাতকে জাতীয় বাজেট ও উন্নয়ন কৌশলে অগ্রাধিকার দেওয়া, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ে নীতি প্রণয়ন, বেসরকারি খাতে পরিবারবান্ধব নীতি গ্রহণ ও যত্নকেন্দ্রিক চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি। পাশাপাশি পুরুষ ও ছেলেদেরকে যত্ন ভাগাভাগিতে উৎসাহিত করা এবং নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
রান্না, কাপড় ধোয়া, ঘর গোছানো, শিশু ও বৃদ্ধের যত্ন নেওয়া কিংবা অসুস্থের সেবা- এমন অসংখ্য কাজের ওপরই ভর করে চলে পরিবার ও সমাজ। তবু এতদিন এই কাজগুলো দেশের অর্থনীতির খাতায় লেখা থাকেনি। নতুন এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো নারীর এই অদৃশ্য শ্রমের অর্থনৈতিক গুরুত্ব জাতীয় পরিসংখ্যানে ধরা হলো।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নারীর অদেখা শ্রমের এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার হিসাব নয়, বরং নীতি ও বাজেটে লিঙ্গ-সংবেদনশীলতা বাড়ানোর জন্য এক বড় ভিত্তি। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারীর অমূল্য অবদানকে দৃশ্যমান করার মাধ্যমে দেশ এক নতুন দিগন্তে প্রবেশ করল।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, নারীর শ্রম দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতির ছায়ায় ছিল। আজকের এই প্রতিবেদন সেই অমূল্য অবদানকে দৃশ্যমান করল।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রধান পরিসংখ্যানবিদ মাহিন্থান জোসেফ মারিয়াসিংহাম ভিডিও বার্তায় এই উদ্যোগকে বাংলাদেশের জন্য একটি ‘অগ্রণী পদক্ষেপ’ বলে অভিহিত করেন।