চট্টগ্রামের রাউজানে চারদিনের ব্যবধানে মো. ইব্রাহিম নামে আরও এক যুবদলকর্মীকে গুলিতে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় এলাকায় চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) দুপুর ১টার দিকে রাউজান সদর ইউপির পূর্ব রাউজান ৮ নম্বর ওয়ার্ডে গাজীপাড়ায় এই ঘটনা ঘটে। নিহত ইব্রাহিমের পিতার নাম মোহাম্মদ আলম। তিনি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন।
এর আগে গত শনিবার রাতে রাউজানের বাগোয়ান গরির উল্লাহ পাড়ায় খুন হন আরেক যুবদলকর্মী আবদুল্লাহ মানিক। এ নিয়ে গত গত আট মাসে রাউজানে ৯টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক শত্রুতায় এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রধান কারণ বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৩টি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে আসা একদল দুর্বৃত্ত ইব্রাহিমকে মাথায় গুলি করে দ্রুত চলে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিনি। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এ ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যা করে চলে যাওয়ার সময় কদলপুর ইউপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের তালুকদার বাড়ির আবুল কালামের ঘরে ভাঙচুর চালায়। এ সময় তার ছেলে মন্নানকে না পেয়ে তার ভাই অটোরিকশাচালক মো. নাঈমের পায়ে এবং হাঁটুতে গুলি করে। তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
তাৎক্ষণিকভাবে কারা এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত এবং এর নেপথ্যে কী কারণ রয়েছে, তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি পুলিশ। তবে স্থানীয়রা বলছেন, ইব্রাহিম এলাকায় যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং কিছুদিন ধরেই রাজনৈতিক বিরোধে তিনি টার্গেটে ছিলেন।
রাউজান থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত) মনিরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এবং সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহসহ আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। প্রাথমিকভাবে এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলেই ধারণা করা হচ্ছে। অপরাধীদের চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশের একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে। নিহত ইব্রাহিমের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে গত আট মাসে রাউজানে ৯টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ, নিহতের স্বজন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চাঁদাবাজি, দখল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ২৮ আগস্ট থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ৯ জন খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জনের বেশি। প্রায় প্রতিদিন ঘটছে দখল, মাটি কাটা, পাহাড় কাটা, চাঁদাবাজি, দলীয় গ্রুপিং এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা। এসব ঘটনায় ব্যবহার হচ্ছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। একের পর এক খুন, সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। ধরা পড়ছে না জড়িতরা। তবে হত্যায় জড়িতরা এলাকায় ঘুরলেও পুলিশ ধরছে না বলে অভিযোগ স্বজনদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ আগস্ট পরবর্তী কিছু বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ ও মারামারির ঘটনা ঘটলেও হত্যাকাণ্ড শুরু হয় ২৮ আগস্ট থেকে। ওই দিন বিকেলে পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরী মার্কেট এলাকায় পিটিয়ে হত্যা করা হয় রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া ইউনিয়নের শ্রমিক লীগ নেতা আব্দুল মান্নানকে (২৭)। তিনি বেতবুনিয়া সুগারমিল ডাকবাংলো এলাকার কবির আহাম্মদের ছেলে। ১ সেপ্টেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাগানবাড়ি থেকে মো. ইউসুফ মিয়া (৬৫) নামে এক ব্যক্তির রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত ইউসুফ রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আবদুল শুক্কুর মিয়ার বাড়ির মৃত শামসু মিয়ার ছেলে।
১১ নভেম্বর নিখোঁজের তিন দিনের মাথায় রক্তাক্ত অবস্থায় হাফেজ মাওলানা আবু তাহের (৪৮) নামে এক মাদ্রাসাশিক্ষকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি রাউজানের চিকদাইর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আকবর শাহ (রহ.) বাড়ির প্রয়াত আব্দুল মান্নানের ছেলে। এ হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক বিরোধে হয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন ধারণা করলেও পুলিশ বলছে এটির তদন্ত চলছে। এখনও কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
গত ২৪ জানুয়ারি উপজেলার নোয়াপাড়া এলাকায় মোটরসাইকেলে করে চট্টগ্রাম শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন মো. জাহাঙ্গীর আলম নামের এক ব্যবসায়ী। জাহাঙ্গীর আলম নোয়াপাড়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নিরামিশপাড়ার মৃত আবু ছৈয়দ মেম্বারের ছেলে। জাহাঙ্গীর নগরের খাতুনগঞ্জের পাইকারি শুঁটকি ব্যবসায়ী ছিলেন।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মুহাম্মদ হাসান (৩৫) নামে এক যুবলীগ কর্মীকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা। নিহত হাসান নোয়াপাড়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আহমেদ হোসেন মেম্বারের বাড়ির মো. বজল আহমেদ ড্রাইভারের ছেলে। তাকেও রাজনৈতিক বিরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি পুলিশের।
গত ১৫ মার্চ ইফতার মাহফিল নিয়ে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়াকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের পিটুনি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন কমর উদ্দিন জিতু (৩৬) নামে এক যুবদল কর্মী। কমর উদ্দিন জিতু হলদিয়া ইউনিয়নের উত্তর সর্ত্তা গ্রামের মুহাম্মদ আলীর ছেলে। তিনিও রাজনৈতিক বিরোধে খুন হন।
গত ২১ মার্চ পূর্বগুজরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বৃহত্তর হোয়ারাপাড়া এলাকার মোবারক খালের পূর্ব পাশে খোলা জমি থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় মো. রুবেল (৩৫) নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। গরু চোর সন্দেহে তাকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। নিহত রুবেল নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার মৃত নুরুল আলমের ছেলে। সর্বশেষ ১৯ এপ্রিল রাতে খুন হন যুবদল কর্মী মানিক আবদুল্লাহ। এ ঘটনায় জড়িত কাউকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
এরপর ১৯ এপ্রিল রাত দেড়টার দিকে চট্টগ্রামের রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের গরিব উল্লাহপাড়া গ্রামে ভাত খাওয়ার সময় গুলি ও ছুরিকাঘাত করে যুবদল কর্মী মানিক আবদুল্লাহকে (৩৬) হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১২-১৫ জনের মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে জানিয়েছেন তার স্বজনরা।