বান্দরবানের লামা উপজেলার পাহাড়ি, সামাজিক ও সংরক্ষিত বনের সিংহভাগ এখন ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে লামার বনাঞ্চল দিন দিন গাছশূন্য হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
মূলত তাদের যোগসাজশেই বন থেকে লাখ লাখ মণ কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে স্থানীয় ইটভাটাগুলোতে। প্রশাসন নামমাত্র জরিমানা করে অবৈধ ইটভাটাগুলোকে নির্বিচারে কাঠ পোড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ স্থানীয়দের।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীত মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে লামায় শুরু হয় গাছ নিধনের মহোৎসব। নিধনে সাবাড় হচ্ছে মাদারট্রি থেকে শুরু করে অল্প বয়সী চারা। ড্রাম্পার ও ট্রাকে লাকড়ি পাচার ওপেন সিক্রেট। প্রশাসন ও বন বিভাগের নাকের ডগায় দিন-দুপুরে এসব চলছে। নীরবে বনভূমি উজাড় হলেও না দেখার ভান করছেন তারা।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন থেকে প্রতিদিন শতাধিক গাড়ি লাকড়ি বোঝাই করে যাচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটা ও তামাক চুল্লিতে। সস্তায় পাওয়া যায়, তাই ইটভাটায় কয়লার পরিবর্তে লাকড়ি ব্যবহার করা হয়। বন আইন অনুসারে বৈধ বা অবৈধ কোনো ধরনের কাঠ রাতে সড়ক দিয়ে পরিবহনের সুযোগ নেই। কিন্তু একশ্রেণির অসাধু বন কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে লামার বিভিন্ন সড়ক দিয়ে প্রতিনিয়ত ইটভাটায় লাখ লাখ মণ লাকড়ি যাচ্ছে।
গাড়িপ্রতি নির্ধারিত চাঁদা দিলেই দেওয়া হয় বিশেষ টোকেন। সেই টোকেন কর্তাদের কাছে জমা হওয়ার পর গাড়ি চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। ডলুছড়ি ও লামা সদর রেঞ্জের আওতাধীন সব বিট অফিসরে সামনে দিয়ে দিনরাত লাকড়ি পরিবহন করা হচ্ছে।
মো. শরিফ, মো. মিজান, মো. কালামসহ স্থানীয় কয়েকজন বলেন, লামা বাজার-সরই, ফাইতং-চকরিয়া, সরই-লোহাগড়া সদর-রুপসীপাড়া এসব সড়ক লাকড়ি পাচারকারীদের দখলে। স্থানীয়রা বাধা দিলে হামলার শিকার হতে হয়। বন বিভাগকে তথ্য দিলে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং পাচারকারীদের সতর্ক করে দেন। প্রশাসন বা বন বিভাগ না চাইলে কোনোভাবে ইটভাটায় লাকড়ি পোড়ানো সম্ভব নয়। মাঝমধ্যে নামমাত্র অভিযান চালিয়ে বরং ইটভাটায় লাকড়ি পোড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
মো. আরিফুর নামে ফাইতং এলাকার একজন বলেন, একটি ইটভাটায় সিজনে (এক বছর) ৮০ হাজার মণ লাকড়ি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সে হিসেবে লামার ২৫টি অবৈধ ইটভাটায় লাখ লাখ মণ কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। প্রতিটি ইটভাটায় লাকড়ির অবৈধ মজুত রয়েছে। কিন্তু বন বিভাগের তেমন কোনো অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যায় না। টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ রাখা হয়। আবার অভিযান কখন হবে, তা আগে থেকে জানেন ইটভাটার মালিকরা, সেই সুযোগে লাকড়ি সরিয়ে ফেলা হয়।
তিনি আরও বলেন, যদিও বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ইটভাটা করার জন্য শর্ত আরোপ করা আছে। কিন্তু ইটভাটার মালিকরা কোনো শর্ত মেনে চলে না। কিছু মালিক চতুরতার সঙ্গে ইটভাটা প্রবেশদ্বারে কিছু কয়লা স্তূপ করে রাখেন। যাতে কোনো কারণে প্রশাসনের লোকজন গেলে তা দেখানো যায়। পাহাড়ের কাঠ পোড়ানোর সুবিধার্থে ফাইতং ইউনিয়নে পাহাড় ও বনভূমি পাশে গড়ে উঠেছে অবৈধ ২৫টি ইটভাটা।
ফাইতং এলাকার লাকড়ি ব্যবসায়ীরা বলেন, রেঞ্জ কর্মকর্তা, বন বিভাগ, থানা ম্যানেজ করার জন্য মণপ্রতি ১৫ টাকা করে লাকড়ি ব্যবসায়ী সমিতির কাছে দিতে হয়। তারা সবকিছু ম্যানেজ করে দেন। ফলে যাতায়াতে বাধা দেওয়ার মতো কেউ নেই। টাকা দিলে বন বিভাগের লোকজন পাহারা দিয়ে লাকড়ি ও কাঠ পাচার করে দেন।
লাকড়ি ও কাঠ ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, ডলুছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিট কর্মীদের ইশারা পেলে লাকড়ি ও গাছের গাড়ি নিরাপদে নিতে পারি। লাকড়ির জন্য ছোট গাড়ি ৫০০ টাকা ও বড় গাড়ি হলে ৭০০ টাকা করে দিতে হয়। চাহিদামতো টাকা না দিলে গাড়ি জব্দ করে মামলা দেওয়া হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, এফএসসি, এমএমবি, বিবিএম, এমবিএম, থ্রিবিএম, এসএবি, এমএইচবি, ইবিএম, ওয়াইএসবি, ফোরবিএম নামে কয়েকটি ইটভাটায় লাকড়ি পোড়ানোর জন্য মজুত করে রাখা হয়েছে।
অভিযোগ অস্বীকার করে ডলুছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিব উল্লাহ বলেন, ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা করে লাকড়ি জব্দসহ গাড়ি ধরে মামলা দিই। অভিযানের পরও কীভাবে কাঠ মজুত ও পোড়ানো হচ্ছে—এমন প্রশ্নের উত্তর দেননি এ কর্মকর্তা।
লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমানের বলেন, কাঠ পাচারের বিষয়টি অনেকদিন ধরেই চলছে। জনবল সংকটের কারণে এসব বিষয়ে চাইলেই ব্যবস্থা নিতে পারি না। ইটভাটায় অভিযান করে লাকড়ি ও গাড়ি জব্দ করছি। বন বিভাগের নামে কেউ টাকা নিচ্ছে কি না, বিষয়টি জানা নেই।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোল্যা রেজাউল করিম বলেন, ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ করে জেলা প্রশাসন। তাদের বলেন, মোবাইল কোর্ট করে বন্ধ করে দিতে।