দিনাজপুর জেলার বিরামপুর উপজেলার খিয়ারমামুদপুর গ্রামে রয়েছে এক অপরূপ জলাভূমি, যেটি এখন পরিচিত হয়ে উঠেছে সাদা শাপলার বিল নামে। বর্ষাকালে বিস্তীর্ণ এ বিলে যখন নৌকা ভেসে চলে, তখন মনে হয় যেন কেউ ফুলের বাগানের ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করছে। শান্ত জলের বুকে অসংখ্য সাদা শাপলা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখ যতদূর যায় শুধু শাপলার সারি, আর সেই সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন শত শত মানুষ এখানে ছুটে আসেন।
কেউ পরিবার নিয়ে, কেউবা বন্ধুদের সঙ্গে, আবার কেউ কেবল প্রকৃতির টানে। দর্শনার্থীরা নৌকায় চড়ে বিল ভ্রমণ করেন, ছবি তোলেন, ভিডিও করেন, আর মুহূর্তগুলো স্মৃতির অ্যালবামে ভরে নেন।
বিলটির আয়তন প্রায় ৬ শত বিঘা। এটি দুই ভাগে বিভক্ত—পশ্চিম অংশের নাম আমরুল বিল এবং পূর্ব অংশের নাম কাললা বিল। বর্ষায় পানি ভরে গেলে বিলটি শাপলায় সেজে ওঠে, আর পানি কমলে কৃষকরা আমন ধান চাষ করেন। ধান কাটার পর পশ্চিম অংশের জমিতে জন্মে আমরুল নামে একধরনের আগাছা, আর পূর্ব অংশে জন্মে কাললা নামের হলদে মুথা জাতীয় আগাছা। সেই থেকে দুটি অংশের এমন নামকরণ।
শাপলা দেখার পাশাপাশি দর্শনার্থীরা বিলের আরেকটি আকর্ষণ খুঁজে পান মাছের মধ্যে। কই, মাগুর, টাকি, পুঁটিসহ নানা রকম মাছ ভোরে স্থানীয় জেলেরা ধরে এনে বিক্রি করেন বিলের পাড়েই। ভ্রমণে আসা মানুষ অনেক সময় সেই তাজা মাছ কিনে বাড়ি ফিরে যান। বিলের মাঝখানে রয়েছে এক দ্বীপসদৃশ সমতলভূমি। সেখানে জেলেরা বাঁশ ও টিনের ছাউনি দিয়ে টং তৈরি করেছেন, যেখানে তারা বিশ্রাম নেন এবং মাছ সংরক্ষণ করেন। এই টং আবার পর্যটকদের আড্ডার জায়গায় পরিণত হয়েছে। স্থানীয় শিল্পীরা সেখানে বসে গান করেন, দর্শনার্থীরাও যোগ দেন সেই মিলনমেলায়। ফলে পুরো বিল যেন হয়ে ওঠে একসঙ্গে প্রকৃতি আর সংস্কৃতির উৎসব।
বিলের সৌন্দর্যকে আরও রঙিন করে তুলেছে স্থানীয় শিশু-কিশোরদের সরল জীবন। তাদের মধ্যে রয়েছে ১০ বছরের মুরাদ, যে সকালে স্কুলে যায় আর বিকেলে নৌকা চালিয়ে দর্শনার্থীদের বিল ভ্রমণ করায়। সকালে ছয়টা থেকে নয়টা পর্যন্ত আর বিকেলে তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সে নৌকায় যাত্রী নিয়ে ঘোরে। ভাড়া নেয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা, কেউ বেশি সময় থাকলে ৩০০ টাকাও দেয়। মুরাদের ছোট্ট হাত যখন বৈঠা চালায়, তখন মনে হয় শাপলার এই স্বর্গীয় বিল যেন তারই আপন ভুবন।
বিল দেখতে আসা দর্শনার্থীরা বিমোহিত হয়ে পড়েন এই প্রকৃতির অপূর্ব রূপে। ঢাকার রাশেদুজ্জামান শাওন বলেন, ‘বিলের দক্ষিণ দিকে ভারতের সীমান্ত, মাঝখানে একটি ছোট জঙ্গল, যেটি দূর থেকে দ্বীপের মতো মনে হয়। চারপাশে অসংখ্য শাপলা আর শালুক, সব মিলিয়ে এক অসাধারণ দৃশ্য।’
স্থানীয় জালাল উদ্দিন রুমী বলেন, ‘আমাদের এলাকার মানুষ ঘুরতে যায় সিলেট, কক্সবাজার বা টাঙ্গুয়ার হাওরে। অথচ আমাদের গ্রামেই এত সুন্দর একটি জায়গা আছে, তা আগে জানতাম না। প্রশাসন যদি বিলটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে, তবে এটি দিনাজপুরের জন্য বড় সম্পদে পরিণত হবে।’
কাটলা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড মেম্বার শুকুর আলী বলেন, ‘প্রতিদিন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শত শত মানুষ এখানে শাপলার বিল দেখতে আসেন। দিন দিন দর্শনার্থীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।’
প্রশাসনের নজরও এরই মধ্যে পড়েছে এই শাপলার বিলে। বিরামপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সালমা আক্তার কালবেলাকে জানান, তিনি শিগগির বিলটি পরিদর্শন করবেন। একই সঙ্গে তিনি দর্শনার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন কেউ ফুল নষ্ট না করেন এবং পরিবেশ রক্ষায় সচেতন থাকেন। প্রয়োজনে জনসচেতনতামূলক প্রচারণাও চালানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
সাদা শাপলার এই বিল এখন শুধু প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের মিলনকেন্দ্র নয়, এটি স্থানীয়দের আয়ের উৎসও হয়ে উঠেছে। জেলে মাছ বিক্রি করে, নৌকা চালিয়ে শিশু-কিশোরেরা উপার্জন করে, আবার দর্শনার্থীরা আনন্দের পাশাপাশি নিয়ে যান স্থানীয় খাবার ও সংস্কৃতির স্বাদ। সঠিক পরিকল্পনা ও যত্ন নিলে এই শাপলার বিল একদিন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। প্রকৃতির কোলে লুকিয়ে থাকা এই জলাভূমি তাই আজ দিনাজপুরের গর্ব।