বর্তমান বিশ্বের অন্যতম স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ও সামরিক ইস্যু হচ্ছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি। দীর্ঘদিন ধরে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। একদিকে ইরান তার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ও আঞ্চলিক আধিপত্য বজায় রাখতে চায়, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বিশেষ করে ইসরাইল, ইরানের সম্ভাব্য পরমাণু অস্ত্র অর্জনকে একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ সংঘাত এক নতুন মোড় নিয়েছে—যেখানে ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকি ও সামরিক উত্তেজনার পাশাপাশি শুরু হয়েছে কূটনৈতিক সংলাপ।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ইতিহাস: শান্তিপূর্ণ না সামরিক?
১৯৫০ সালের দিকে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি শুরু হয়েছিল। পশ্চিমা মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই তাদের এ প্রযুক্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনামলে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে রিয়্যাক্টর নির্মাণে চুক্তিও হয়। লক্ষ্য ছিল মূলত শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে জ্বালানি উৎপাদন।
কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লব সবকিছু পাল্টে দেয়। শাহের পতনের পর রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে পশ্চিমারা ইরানের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। পরমাণু প্রকল্পগুলোর আন্তর্জাতিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ইরান নিজের মতো করে প্রযুক্তি উন্নয়ন শুরু করে, যা ধীরে ধীরে গোপনীয়তা ও সন্দেহের জন্ম দেয়।
২০০২ সালে আন্তর্জাতিক মহলে ইরানের নাতাঞ্জ ও আরাক পরমাণু কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের খবর সামনে আসে। এরপর থেকেই শুরু হয় পশ্চিমা বিশ্বের উদ্বেগ, আর ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা।
২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি এবং উত্তেজনা
যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ছয় পরাশক্তির (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন ও জার্মানি) সঙ্গে ইরান ২০১৫ সালে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তির মাধ্যমে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ সীমায় রাখতে সম্মত হয় এবং সর্বোচ্চ ৩০০ কেজি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ করতে পারে। হাজার হাজার সেন্ট্রিফিউজ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এর বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় এবং দেশটি আবার বৈশ্বিক তেলবাজারে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন চুক্তি থেকে একতরফাভাবে সরে আসে। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, চুক্তি ইরানকে ব্যালিস্টিক মিসাইল উন্নয়ন বা মধ্যপ্রাচ্যে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ফলে আবার শুরু হয় উত্তেজনা।
ইরানের সামরিক সক্ষমতা: হুমকি না প্রতিরক্ষা?
বর্তমানে ইরান দাবি করছে তারা ৯০০-রও বেশি ধরনের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি নিজেরা তৈরি করছে। এর মধ্যে রয়েছে ড্রোন, ব্যালিস্টিক মিসাইল, সাইবার যুদ্ধ প্রযুক্তি, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি। ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, এগুলো শুধুই প্রতিরক্ষার জন্য। তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী এটি রাজনৈতিক চাপে ব্যবহার হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরান এখন আর আগের মতো দুর্বল নয়। একদিকে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া, লেবানন (হিজবুল্লাহ), ইরাক ও ইয়েমেনে প্রভাব—সব মিলিয়ে তারা একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ফলে যুক্তরাষ্ট্র এখন কেবল সামরিক সমাধান নয়, আলোচনার পথেও আগ্রহী।
সাম্প্রতিক আলোচনার প্রেক্ষাপট
সম্প্রতি ওমানের রাজধানী মাসকটে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। এ বৈঠককে বিশ্লেষকরা ‘ঐতিহাসিক’ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ ২০১৮ সালের পর এই প্রথম এত উচ্চ পর্যায়ের সংলাপ অনুষ্ঠিত হলো।
বৈঠকটি সরাসরি না হলেও ওমানের মধ্যস্থতায় পরোক্ষভাবে দুপক্ষের মধ্যে বার্তা আদান-প্রদান হয়। ইরানের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। এই আড়াই ঘণ্টার বৈঠকে দুই পক্ষই আলোচনার পরিবেশকে ‘শান্ত ও ইতিবাচক’ বলে উল্লেখ করে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এ বৈঠকে কোনো ছবি তোলা হয়নি এবং আলোচনায় সরাসরি মুখোমুখি হয়নি দুপক্ষ—এটি ইরানের কট্টরপন্থীদের চাপে নেওয়া কৌশল। তবে উভয়পক্ষই স্বল্পমেয়াদে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে এবং ১৯ এপ্রিল দ্বিতীয় দফা বৈঠকের পরিকল্পনা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা
যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই দাবি করে আসছে, ইরান যদি চায় তবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়, ইরান ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে এবং তা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ে গেলে এটি অস্ত্র-মানের হবে। এই আশঙ্কাই মূলত যুক্তরাষ্ট্রকে বারবার আলোচনায় টানছে।
তাদের ভয়, একদিন হঠাৎ করেই ইরান গাজা বা ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। আর এই অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল বৈশ্বিক তেলবাজারে নেমে আসবে ধস, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে।
ইরানের অবস্থান: হুমকি নাকি আত্মরক্ষা
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেনির উপদেষ্টারা স্পষ্টভাবে বলেছেন, যদি ইরানকে বাধ্য করা হয় বা আক্রমণের হুমকি দেওয়া হয়, তাহলে তারা আত্মরক্ষার্থে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। তারা বারবার বলে এসেছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ, তবে আত্মরক্ষার জন্য তারা যেকোনো কিছু করতে পারে।
এই বার্তা যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দিচ্ছে—ইরান আলোচনায় আগ্রহী, কিন্তু ভয় দেখিয়ে তাদের থেকে কিছুই আদায় করা যাবে না।
যুদ্ধ নাকি সমঝোতা
বিশ্ব আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে রয়েছে ইরানের ক্রমবর্ধমান সামরিক সক্ষমতা, পরমাণু শক্তির কাছাকাছি অবস্থান, এবং আঞ্চলিক প্রভাব। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তা ও বিশ্ব নেতৃত্ব ধরে রাখতে চাইছে। ফলে, দুপক্ষই বুঝতে পারছে সামরিক সংঘাত হলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।
এজন্যই হয়তো আজ ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকি ছাপিয়ে আলোচনা টেবিলে ফিরেছে ওয়াশিংটন ও তেহরান। বিশ্ববাসী এখন অপেক্ষা করছে—এই বাঘ-বন্দি খেলায় জয়ী হবে কে?