ফিলিস্তিনের গাজায় চার মাস ধরে সর্বাত্মক অবরোধ দিয়ে রেখেছে ইসরায়েল। এর মধ্যে চালাচ্ছে স্থল ও আকাশ অভিযান। সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, আশ্রয়কেন্দ্রসহ সব স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে তারা। নির্বিচারে হত্যা করছে সবাইকে, হত্যাযজ্ঞ থেকে বাদ পড়ছে না নিরীহ নারী-শিশুও। এ উপত্যকার সব হাসপাতালও দফায় দফায় আক্রান্ত হচ্ছে। অবরোধে অনাহারে মারা যাচ্ছে শিশুরা। ফার্মেসিগুলোতে শেষ হয়ে গেছে ওষুধ। অনাহারে অথবা গুলিতে যখন মৃত্যুই একমাত্র গন্তব্য, তখন ত্রাণের নামে অভুক্তদের প্রলুব্ধ করে ত্রাণকেন্দ্রে নিয়ে প্রায় দিনই গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে যখন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসির জারি আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে চাপ বাড়ছে, দখলদার রাষ্ট্রের মিত্ররাও মুখ খুলতে শুরু করে, একতরফাভাবে তেল আবিবের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়—ঠিক তেমন একটি সময় ১৩ জুন ইরানে হামলা করে ইসরায়েল। তার মানে কি চলমান সমালোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া? বিশ্ববাসীর নজর গাজা থেকে সরিয়ে নেওয়া? তবে ইরানের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধেও গাজায় আগ্রাসন থামেনি। যুদ্ধ শেষে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ধ্বংসযজ্ঞও বেড়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন হুমায়ূন কবির গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে হামলা চালানো হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় গাজায় সর্বাত্মক হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এ অভিযানে গাজায় প্রায় শতভাগ বাড়িঘর ধ্বংস করেছে তেল আবিবের বাহিনী। এ উপত্যকার ৩৫টি হাসপাতালে কয়েক দফায় হামলা হয়েছে। সব বিদ্যালয় ও শরণার্থী শিবির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো—গত মার্চ থেকে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে ইসরায়েল জোরদার স্থল অভিযান শুরু করে এবং সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করে। এতে তারা পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, খাদ্য ও ওষুধের মতো নিত্যপণ্যও সেখানে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। এতে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি অনাহারে ভুগছেন। এর মধ্যে মাস খানেক আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত এক এনজিওর মাধ্যমে ত্রাণ সরবরাহের অনুমোদন দেয় তেল আবিব। তবে সেখানে ত্রাণ আনতে গিয়ে এ পর্যন্ত অন্তত সাড়ে ৫০০ ফিলিস্তিনিকে জীবন দিতে হয়েছে গুলিতে।
বিষয়টি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের হুমকি দেয়। গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামের বিতর্কিত একটি সংস্থা এই সাহায্য কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে এই ত্রাণকাজ পরিচালিত হচ্ছে। সমালোচকরা মনে করেন, গাজার প্রকৃত মানবিক প্রয়োজনের বদলে রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই বিতরণ ব্যবস্থা চালু করেছে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র।
জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, জিএইচএফ পরিচালিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের চিত্র হৃদয়বিদারক। ডুজারিক বলেন, ‘আমরা ও আমাদের অংশীদারদের একটি সুসংগঠিত ও নীতিনির্ভর পরিকল্পনা আছে, যা গাজা, সুদান, মিয়ানমারসহ যেখানেই হোক—সব জায়গায় একই মানবিক নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।’
মহাসচিবের মুখপাত্র বলেন, জিএইচএফের পরিকল্পনা মানবিক মানদণ্ড পূরণ করে না।
এর মধ্যে অবরোধ প্রত্যাহার ও আগ্রাসন বন্ধের দাবি জানান যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডার নেতারা। অবরুদ্ধ এ ছিটমহলে সামরিক আক্রমণ বন্ধ না করলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়াসহ কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তারা।
এক যৌথ বিবৃতিতে কিয়ের স্টারমার, ইমানুয়েল মাখোঁ ও মার্ক কার্নি বলেছেন, ‘নেতানিয়াহু সরকার যখন এই জঘন্য কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা চুপ করে থাকব না। যদি ইসরায়েল নতুন করে শুরু হওয়া এই সামরিক আক্রমণ বন্ধ না করে এবং মানবিক সহায়তার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে না নেয় তাহলে আমরা আরও কঠোর পদক্ষেপ নেব।’
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের মাধ্যমে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এই লক্ষ্যে অন্যদের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।’
এদিকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণ নীতির বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছেন এই বিশ্ব নেতারা।
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে ফ্রান্স ‘অটল ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’ বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ-নোয়েল বারো। তিনি বলেন, যা কিছুই হোক না কেন, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরে যা ঘটছে, তা ভুলে যাওয়া চলবে না।
বারো বলেন, আমরা একটি সমষ্টিগত উদ্যোগের অংশ হিসেবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যার লক্ষ্য ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের একটি রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব করে তোলা।
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় অব্যাহত মানবিক সংকটের প্রতি ইঙ্গিত করে ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মানবিক সহায়তা যেন অবিলম্বে গাজায় প্রবেশ করতে পারে এবং হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়—এ দুই বিষয় আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, এই সংকটের পেছনের রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকলে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি সম্ভব নয়।
ফ্রান্সের মতো একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র যখন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেয়, তা শুধু প্রতীকী অবস্থান নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। গাজা সংকট, ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা এখনো অনেকাংশে নীতিনির্ধারণী হয়ে উঠতে পারেনি। তবে ফ্রান্স ও স্পেনের মতো দেশগুলোর অবস্থান সেই ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে।
এসব বিষয়ে নেতানিয়াহু যখন সমালোচনায় বিদ্ধ, তখন ইরানে হামলা চালায় ইসরায়েল। ১৩ জুন ভোরে দেশটির পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায় তেল আবিব। এ হামলার প্রধান কারণ হিসেবে ইসরায়েলের পক্ষে দাবি করা হয়—ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি খুব কাছাকাছি। তাকে এ অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা ঠেকাতেই তেল আবিবের হামলা। পরে অবশ্য ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। এর মধ্যে ২৪ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান ও ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দেন।
তেল আবিব যতই বলুক এই হামলা ইরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরি ঠেকাতে, তবে তা মানতে নারাজ বিশ্লেষকরা। ইরানে হামলার মধ্যে গাজায় কিন্তু গণহত্যা থামেনি। ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই ফের ফিলিস্তিনে আগ্রাসন বাড়িয়েছে দখলদার বাহিনী।
আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গ বলেছেন, ইরানে হামলার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যেসব যুক্তি দিয়েছে, বাস্তবে এসবের বাইরেও কারণ আছে। গাজায় গণহত্যামূলক অভিযানের মধ্যে নেতানিয়াহু খুব ভালোভাবেই জানেন যে, তার সরকারের সামনে বিকল্প ফুরিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও তার আঞ্চলিক মিত্ররা ইসরায়েলের সমালোচনা করতে শুরু করেছে। কেউ কেউ একতরফাভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির পথেও এগোচ্ছে।
ইরান যুদ্ধে যখন গাজা থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি সরে গেল, তখন যুদ্ধ শেষে ইসরায়েলি সেনাপ্রধান বললেন, সেনাবাহিনীকে এখন গাজায় মনোযোগ দিতে হবে। এর মাধ্যমে তিনি গাজা পুরোপুরি দখলের ইঙ্গিত দেন।