বিশ্ব

জেন-জি’র ক্ষোভে টালমাটাল প্রতিবেশী দেশগুলো, আঁচ পড়বে ভারতেও?

জেন-জি’র ক্ষোভে টালমাটাল প্রতিবেশী দেশগুলো, আঁচ পড়বে ভারতেও?


দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে আবারও সামনে এলো তরুণদের শক্তি। বিশেষ করে জেনারেশন-জেড, যারা প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেড়ে ওঠা এক নতুন প্রজন্ম, তাদের ক্ষোভেই এখন টালমাটাল নেপাল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ছিল এই বিক্ষোভের সূচনা। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই আন্দোলন রূপ নেয় দুর্নীতিবিরোধী অভ্যুত্থানে। শেষ পর্যন্ত এর চাপেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি।

কীভাবে শুরু হলো আন্দোলন

গত ৪ সেপ্টেম্বর নেপাল সরকার হঠাৎ করেই ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউবসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেয়। সরকারের দাবি ছিল—বিদেশি মালিকানাধীন এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে রাজস্ব আদায় এবং আরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণরা এই পদক্ষেপে তীব্র ক্ষুব্ধ হয়।

প্রথমদিকে আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। ছাত্র-তরুণরা মিছিল ও মানববন্ধনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু দ্রুতই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন মাত্রা যোগ করে। অবশেষে যখন আন্দোলন দমন করতে গুলি চালানো হয় এবং অন্তত ১৯ জন প্রাণ হারায়, তখন পরিস্থিতি আরও বিস্ফোরক হয়ে ওঠে।

জেন-জেডের নেতৃত্ব

এই আন্দোলনের কেন্দ্রে রয়েছে জেনারেশন-জেড—যাদের জন্ম মূলত ১৯৯০-এর দশকের শেষ থেকে একবিংশ শতাব্দীর শুরুর মধ্যে। তারা দাবি করছে, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই। তারা চাইছে সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং স্বাধীনতা।

টিকটক, যেটি নিষিদ্ধ হয়নি, সেটিতে আন্দোলনকারীরা হাজারো ভিডিও প্রকাশ করেছে। দুর্নীতি, বেকারত্ব, সামাজিক বৈষম্য এবং সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে তারা সরব হয়েছে। এসব ভিডিওই অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে পথে নামতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধকরণই যেন তাদের শেষ ধাক্কা হয়ে দাঁড়ায়।

দক্ষিণ এশিয়ায় তরুণদের বিক্ষোভের ধারা

নেপালের ঘটনাটি একেবারে আলাদা নয়। এর আগে দক্ষিণ এশিয়ার আরও দুটি দেশ একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে-

বাংলাদেশে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্রদের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলন দ্রুত রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেই আন্দোলনেরও নেতৃত্বে ছিল তরুণরা।

শ্রীলঙ্কায়, ২০২২ সালে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, খাদ্য ও জ্বালানির ঘাটতি এবং লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। দুর্নীতির অভিযোগ যুক্ত হওয়ায় তরুণরা রাস্তায় নামে। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে ও তার পরিবার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের নির্বাচনে অনুরা কুমারা দিশানায়েকের নেতৃত্বে বামপন্থি জোট ক্ষমতায় আসে।

ফলে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, জেন-জেড এখন আর শুধু দর্শক নয়। তারা রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের বড় চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে।

নেপালের বর্তমান পরিস্থিতি

অলির পদত্যাগে নেপালের রাজনৈতিক সংকট নতুন মোড় নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পৌডেলও পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলো নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তবে পরিস্থিতি জটিল। সেনাবাহিনী ইতোমধ্যেই দেশব্যাপী নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে এবং মন্ত্রীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

নেপালের পোখরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক যোগ রাজ লামিছানে মন্তব্য করেছেন—‘তরুণদের হতাশা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতি অবিশ্বাস এই বিক্ষোভকে আরও বিস্ফোরক করেছে। তারা মনে করে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে তাদের বাদ রাখা হয়েছে। তাই অভিযোগগুলো কেবল সাম্প্রতিক নয়, বরং গভীরভাবে প্রোথিত।’

প্রতিবেশী ভারতের প্রতিক্রিয়া ও আঞ্চলিক প্রভাব

ভারত ইতোমধ্যেই নেপালের সহিংসতা ও প্রাণহানির নিন্দা জানিয়েছে। একই সঙ্গে উন্মুক্ত সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের সীমান্ত এলাকাগুলোতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। তবে নয়াদিল্লি বলছে, নিজেদের দেশে এমন আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার কোনো আশঙ্কা তারা করছে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নেপালের অস্থিরতা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন চাপ সৃষ্টি করবে। ভারতের নিরাপত্তা, আঞ্চলিক অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক ভারসাম্যের ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে। এই নতুন প্রজন্মের তরুণরা যেভাবে একের পর এক দেশের শাসনব্যবস্থায় কাঁপন ধরাচ্ছে তা যে-কোনো গতানুগতিক শাসনব্যবস্থার জন্য উদ্বেগের জন্ম দিতে পারে।





Source link

Shares:
মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।