শীতকালে বরফে ঢাকা রাস্তা বা ফুটপাতে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ পিছলে পড়ে গেছেন—এমন অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই আছে। ছোটবেলা থেকে বইয়ে আমরা পড়ে এসেছি, বরফ পিচ্ছিল হয় কারণ চাপ বা ঘর্ষণের ফলে তার ওপর পানি তৈরি হয়। কিন্তু জানেন কি, এই ধারণা প্রায় ২০০ বছর ধরে ভুল ছিল?
জার্মানির সারল্যান্ড ইউনিভার্সিটির একদল বিজ্ঞানী বরফের পিচ্ছিল হওয়ার প্রকৃত কারণ খুঁজে পেয়েছেন। আর সেটা একেবারেই নতুন ও চমকপ্রদ!
ঘর্ষণ নয়, কাজ করছে ‘ডাইপোল’ নামের এক জাদুকরী বৈশিষ্ট্য
গবেষণায় দেখা গেছে, বরফ পিচ্ছিল হয় মূলত এক ধরনের অণুর বৈদ্যুতিক গুণ বা ‘ডাইপোল’ বৈশিষ্ট্যের জন্য।
অর্থাৎ, আমাদের জুতার তলা আর বরফের অণুর মধ্যে একধরনের বৈদ্যুতিক টানাপোড়েন হয়, আর সেখান থেকেই শুরু হয় মজার খেলা।
ডাইপোল মানে হলো—একটি অণুর ভেতরে যখন আংশিক ধনাত্মক ও আংশিক ঋণাত্মক চার্জ থাকে, তখন সেটি একটি নির্দিষ্ট দিকে বৈদ্যুতিক আকর্ষণ তৈরি করে। পানির অণুতেও এমন ডাইপোল থাকে।
বরফের গঠন ভেঙে পড়ে… আর তখনই হয় পিচ্ছিল
বরফের অণুরা ঠান্ডায় খুব নিয়ম করে সাজানো থাকে, যেন একটা দারুণ সুশৃঙ্খল কাঠামো। কিন্তু কেউ যখন বরফে পা রাখেন বা স্কেটিং করেন, তখন পায়ের নিচে থাকা বস্তুটির ডাইপোল বরফের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে।
এই মিথস্ক্রিয়ার কারণে বরফের অণুরা হঠাৎ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে—একে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘ফ্রাস্ট্রেশন’। ফলাফল? বরফের ওপর এক ধরনের তরল স্তর তৈরি হয়, আর সেটাই বরফকে পিচ্ছিল করে তোলে।
গবেষকরা বলেন, আসলে চাপ বা ঘর্ষণ বড় কোনো ভূমিকা রাখে না, বরং এই মলিকিউলার লেভেলের বৈদ্যুতিক মিথস্ক্রিয়াই আসল কারণ।
তাপমাত্রা যতই কম হোক, এই প্রক্রিয়া থামে না!
আগে মনে করা হতো, মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে বরফের গলে কোনো পানি তৈরি হয় না—তাই এত ঠান্ডায় স্কি করা সম্ভব নয়। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে, ডাইপোলের এই খেলা এত ঠান্ডাতেও চলে, আর বরফের নিচে তৈরি হয় এক ধরনের ঘন, আঠালো স্তর।
তবে এই স্তর এতটাই ঘন (viscous) হয় যে তার সান্দ্রতা মধুর চেয়েও বেশি! তাই স্কি করা তখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বিজ্ঞানীদের চোখে এটি বড় এক আবিষ্কার
এই গবেষণা শুধু বরফ নিয়ে আমাদের ভাবনার পরিবর্তনই নয়, বরং পদার্থবিজ্ঞান ও উপাদান বিজ্ঞানের জগতে এটি এক বড় অগ্রগতি। এর ফলে বরফ, ঘর্ষণ এবং বিভিন্ন পদার্থের গঠনের বিষয়ে নতুনভাবে ভাবার দরজা খুলে যাচ্ছে।
গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে “ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস” নামের আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নালে, এবং ইতোমধ্যেই তা বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করেছে।
২০০ বছর ধরে আমরা যা বিশ্বাস করে এসেছি, সেটাই এখন ভেঙে যাচ্ছে। বরফ পিচ্ছিল হয় শুধু চাপ বা ঘর্ষণের জন্য নয়—বরং তার অণুর গভীরে লুকিয়ে থাকা এক জটিল বৈদ্যুতিক খেলার কারণে।
এটাই বিজ্ঞান—নতুন আবিষ্কার, নতুন ভাবনা, আর পুরনো ভুল ভেঙে সামনে এগিয়ে চলা।