কাশ্মীরের পহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যু ঘটেছে। এ ঘটনায় ভারতের প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণ এশিয়ায় আবারও যুদ্ধের শঙ্কা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। হামলার দায় পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে দিলেও এখন পর্যন্ত দিল্লি কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেনি। কিন্তু ভারতের সেনাবাহিনী ও সরকারের কড়া পদক্ষেপে এ প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে—এই সংঘাত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? শেষ পর্যায়ে কি পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার পর্যন্ত গড়াতে পারে?
হামলার পর পরই ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং জানিয়েছেন, কেবল সন্ত্রাসীদের নয়, তাদের পেছনের পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপর থেকেই সীমান্তে সেনা মোতায়েন বাড়ানো হয়েছে, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত পারাপার, এমনকি ভারত একতরফাভাবে সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণাও দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে ‘মিসক্যালকুলেশন’ বা ভুল হিসাবের আশঙ্কা। উভয় দেশের কাছে বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র থাকায় সংঘাত সীমিত না থেকে বিস্তৃত আকারও নিতে পারে।
ভারতের সামরিক ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন বিবিসিকে বলেন, ২০১৬ ও ২০১৯ সালে সীমিত পরিসরে হামলা চালিয়ে ভারত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দিয়েছিল। এবারের ঘটনাও হয়তো সে পথেই যাবে। এখন ভারতের প্রতিক্রিয়ার মাত্রা হবে কতটা ক্যালিব্রেটেড বা নিয়ন্ত্রিত—সেটাই দেখার বিষয়। তার মতে, ভারত সরকার এমন একটি বার্তা দিতে চাইবে যাতে পাকিস্তান ও দেশের জনগণ দুই পক্ষই বোঝে, ভারত কঠোর ও সক্ষম।
তিনি বলেন, কিন্তু ভুল হিসাবের ঝুঁকি সবসময় থাকে। একপক্ষ একটু বেশিই প্রতিক্রিয়া দেখালে, অপরপক্ষও পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিতে বাধ্য হয়—এভাবে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে।
এর আগে ২০১৬ সালে উরি হামলার পর ভারত সীমান্ত পার হয়ে পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায়। এরপর ২০১৯ সালের পুলওয়ামা বিস্ফোরণের পর ভারত পাকিস্তানের ভেতরে বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। ওই ঘটনার পর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানও বিমান হামলা চালায় এবং ভারতীয় পাইলট আভিনন্দন বন্দি হন। এই দুই ঘটনার মতোই বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘সীমিত প্রতিশোধ’ এর সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ২০১৬ ও ২০১৯ সালে ভারত প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে যে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ বা ‘মানদণ্ড’ তৈরি করেছে, এখন যদি সেই মানদণ্ডের চেয়ে কম কিছু করে, তাহলে তা জনগণের চোখে দুর্বলতা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, যেহেতু নিহতরা বেসামরিক নাগরিক, আর ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা অনেক বেশি—তাই ভারতীয় জনগণের ভেতর প্রতিশোধের চাপ বাড়বে।
তবে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার জায়গা হলো উভয় দেশই পারমাণবিক শক্তিধর। কুগেলম্যান সতর্ক করে বলেন, এ ধরনের প্রতিক্রিয়া থেকে দুই দেশের মধ্যে বড় সংঘর্ষ তৈরি হতে পারে, এবং সেটা পরমাণু সংঘাতের দিকেও গড়াতে পারে—যদিও দুই পক্ষই তা চাইবে না।
মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ভারত কিছুটা সীমিত আকারে পাল্টা আঘাত হানতে পারে, কিন্তু পাকিস্তান তা কীভাবে গ্রহণ করবে সেটাই মূল প্রশ্ন। কারণ প্রতিটি প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি আছে।
অনেকেই আশঙ্কা করছেন, যুদ্ধ শুরু হলে তা হয়তো দ্রুতই বন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু বিপদ হলো—যুদ্ধ একবার শুরু হলে তা কতোদূর যাবে, তা কেউ জানে না।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসেইন হাক্কানি বলেন, ভারতের সীমিত পরিসরের স্ট্রাইক যদি হয়, তাহলে পাকিস্তান হয়তো প্রতিশোধে যাবে না। কিন্তু যদি তা গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার পায়, তবে পাকিস্তানের ওপর পাল্টা চাপ বাড়বে। তখন উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে যাবে।
বিবিসির তথ্য অবলম্বনে