তাইওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রকে ঘিরে উত্তেজনার মধ্যে হাইড্রোজেনভিত্তিক ‘ক্লিন এনার্জি’ বোমার পরীক্ষা চালিয়েছে চীন। এর ফলে নতুন করে আলোচনায় এসেছে হাইড্রোজেন বোমা। এটি আসলে কতটা ভয়ংকর তা নিয়ে আগ্রহ আর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ।
হাইড্রোজেন বোমা বা তাপীয় পারমাণবিক বোমা আধুনিক যুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক আবিষ্কার। এর ভয়াবহতা শুধু একটি দেশ বা অঞ্চলের জন্য নয়, গোটা মানবজাতির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। কিন্তু কেন এই অস্ত্রটি এতটা ভয়ঙ্কর তা নিম্নে তুলে ধরা হলো।
হিরোশিমার বোমার চেয়ে হাজার গুণ শক্তিশালী
সাধারণ পারমাণবিক বোমা (ফিশনভিত্তিক) যেমন হিরোশিমায় ব্যবহৃত হয়েছিল, তার শক্তির উৎস ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামের বিভাজন। কিন্তু হাইড্রোজেন বোমা হাইড্রোজেন আইসোটোপের সংযোজন (ফিউশন) প্রক্রিয়ায় কাজ করে, যা ১০০ থেকে এক হাজার গুণ বেশি শক্তি উৎপন্ন করে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরীক্ষা করা জার বোমার শক্তি ছিল ৫০ মেগাটন (হিরোশিমার বোমার ৩,৮০০ গুণ!)। এই বিস্ফোরণে সৃষ্ট আগুনের গোলাকার ব্যাস ছিল ৮ কিলোমিটার, আর আলো দেখা গিয়েছিল এক হাজার কিলোমিটার দূর থেকে।
সেকেন্ডেই সব ধ্বংস
নতুন ধরনের এই বোমা পারমাণবিক নয়, তবে এটি অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রার (১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি) আগুনের গোলা তৈরি করতে পারে, যা দুই সেকেন্ড ধরে জ্বলতে থাকে। ফলে খোলা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা সেনাদের দমন, রাস্তাঘাট বা সেতু ধ্বংস, কিংবা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে ‘সার্জিক্যাল’ হামলার জন্য এটি কার্যকর হতে পারে।
তাপীয় বিকিরণ: বিস্ফোরণের কেন্দ্রে তাপমাত্রা পৌঁছায় কয়েক কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা প্রায় সূর্যের তাপমাত্রার কাছাকাছি! এই তাপমাত্রা পুরো এলাকার সব জীবিত প্রাণীর চামড়া গলিয়ে দিতে পারে।
শক ওয়েভ: বিস্ফোরণের চাপ বিল্ডিং, সেতু, এমনকি পাহাড়ও ধসিয়ে দিতে পারে। এর ফলে অন্য যে কোনো বোমার চেয়ে এটি বহুগুণ ভয়ংকর। জার বোমার ক্ষেত্রে, এর শকওয়েভ পৃথিবীকে তিনবার প্রদক্ষিণ করেছিল।
আগুনের ঝড় : এ বোমার ফলে সৃষ্ট তাপমাত্রার চাপের সমন্বয়ে সৃষ্ট ফায়ারস্টর্ম পুরো শহরকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে।
বিষাক্ত রেডিওঅ্যাকটিভ কণা
হাইড্রোজেন বোমা শুধু বিস্ফোরণেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি দীর্ঘমেয়াদি রেডিওঅ্যাকটিভ দূষণ সৃষ্টি করে। ফিশন-ফিউশন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন সিজিয়াম-১৩৭, স্ট্রনশিয়াম-৯০-এর মতো ভয়ংকর কণা বাতাস, মাটি ও পানিতে মিশে ক্যান্সার, জিনগত বিকৃতি ও অনাগত শিশুর ক্ষতি করে। ১৯৫৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্যাসল ব্র্যাভো’ পরীক্ষার fallout জাপানের একটি মাছধরার জাহাজে ১০০ কিলোমিটার দূরেও রেডিয়েশন ছড়িয়েছিল, যাতে ১ জনের মৃত্যু ও বহুজন অসুস্থ হয়েছিল।
বৈশ্বিক বিপর্যয়
হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়া ধুলো ও ধোঁয়া সূর্যের আলোর জন্য বাধা সৃষ্টি করে। এর ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা হঠাৎ করেই হিমাঙ্কের নিচে নেমে যেতে পারে, যা কৃষি ধ্বংস করে বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ ডেকে আনবে। বিজ্ঞানীদের মতে, মাত্র ১০০টি বড় আকারের হাইড্রোজেন বোমাই মানবসভ্যতাকে মধ্যযুগীয় পর্যায়ে ফিরিয়ে নিতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, হাইড্রোজেন বোমার অস্ত্রায়ন পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) লঙ্ঘন। তবে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোর হাতে এই প্রযুক্তি রয়েছে। ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বে এখনো ১২,৫০০-এর বেশি পারমাণবিক অস্ত্র সক্রিয় আছে, যার অনেকগুলোই হাইড্রোজেন বোমা।
হাইড্রোজেন বোমায় দুটি ধাপের বিস্ফোরণ ঘটে। প্রথমে ফিশন (পারমাণবিক বিভাজন), তারপর ফিউশন (পরমাণু সংযুক্তি)। এই ফিউশন প্রক্রিয়ায় প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়, যা বোমাটিকে আরও বিধ্বংসী করে তোলে। এ ধরনের অস্ত্র বিস্ফোরণে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয়তা ও তাপমাত্রা পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে, যা মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।
সম্প্রতি চীন একটি নতুন ধরনের হাইড্রোজেন বোমার সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। এই বোমাটি মাত্র ২ কেজি ওজনের এবং এতে ম্যাগনেসিয়াম হাইড্রাইড ব্যবহার করা হয়েছে, যা প্রচলিত ট্যাংকের তুলনায় অনেক বেশি হাইড্রোজেন সংরক্ষণ করতে পারে। দেশটি বোমাকে ‘ক্লিন এনার্জি অস্ত্র’ হিসেবে তুলে ধরলেও এর লক্ষ্য- শত্রু ঘাঁটি ধ্বংস করা, কৌশলগত এলাকা দখল রোধ ও প্রয়োজন হলে নির্দিষ্ট এলাকায় অগ্নি-আক্রমণ চালানো।